Pages

Sunday, September 27, 2009

সংকট থেকে মুক্তি চাই

[ লেখাটি ২০০৮ জুন,যায়যায়দিন প্রকাশিত ]
সাইফ বরকতুল্লাহএক.
বর্তমানে একটি অনির্বাচিত অস্থায়ী সরকার দেশ চালাচ্ছে। দেশে কোন পার্লামেন্ট নেই। ফলে সমাজের সকলস্তরের মানুষের ব্যথা বেদনা ও অভাব অভিযোগ মূল্যায়ন করে জাতীয় বাজেট প্রণয়ন বা পণ্যমূল্য নির্ধারণের ব্যাপারে সরকারের উদাসীনতা ও অনভিজ্ঞতা সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সংকটকে আরও তীব্র করে তুলতে পারে।
উল্লেখ্য, এ সরকারের আমলে চাল, ডালসহ প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ভারে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ। রফতানি বাণিজ্যের সংকোচন, গার্মেন্টস সেক্টরে অস্থিরতা এবং বৈদেশিক শ্রমবাজারে ধস নামার আশঙ্কায় বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ধরণের বিপর্যয়ের আতঙ্কে রয়েছে।
দুই.
খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে বাংলাদেশ ঝূঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। মানুষের মৌলিক প্রয়োজনের মধ্যে খাদ্যের স্থান সর্বোচ্চ। কেননা বেঁচে থাকার জন্য পানি বায়ুর মতো খাদ্যের Ab¯^xKvh© অপরিহার্যতা মানবসভ্যতার সূচনাকাল থেকেই ¯^xK…Z খাদ্য ব্যবস্থাপনাজনিত ত্রুটি এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বাংলদেশ ¯^iYKv‡ji মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ খাদ্য সংকট মোকাবিলা করছে।
তিন.
প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের খুচরা মূল্য যেখানে ছিল ৫টাকা ৩০পয়সা, সেখানে নতুন মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১০টাকা ৭০ পয়সা। শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী সাংবাদিক সম্মেলন করে এই অপ্রিয় সিদ্ধান্তটি জানিয়েছেন। উপদেষ্টার মতে, সারের দাম বাড়ানো সত্বেও এখানে কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় বাড়বেনা। সঠিক মাত্রায় ইউরিয়া সারের প্রয়োগ ও অপচয় রোধের মাধ্যমে কৃষকরা সার খাতের mgš^q করতে পারবেন বলে উপদেষ্টা যুক্তি দেখিয়েছেন। তবে তার এই একতরফা কুযুক্তি মাঠ পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।
প্রতি ফসলী মওসুমেই কৃষকরা সারের জন্য হাহাকার করেন। অর্থাৎ সার বিপণন ও বন্টন ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে সময়মতো কৃষকদের হাতে সার পৌঁছে না। ফলে প্রতিবছরই সারের জন্য কৃষকদের বিক্ষোভ প্রতিবাদ ঘেরাও পর্যন্ত করতে হয়। সে অবস্থা এবারও অপেক্ষমান।
চার.
দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এখন স্থবিরতা বিরাজ করছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কর্মসংস্থানের পথ রুদ্ধ হচ্ছে। অনেক কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার সমস্যা বাড়ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেশি হওয়ায় এবং ঋণ পাওয়ার জটিলতার কারণে তারা নতুন কোনো শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে পারছেন না। বিনিয়োগ বোর্ডের বরাত দিয়ে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে, গত বছরের প্রথম ছয় মাসে আগের বছরের ছয় মাসের তুলনায় দেশী বিনিয়োগ নিবন্ধন অর্ধেকে নেমে এসেছে। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে প্রায় ৬ হাজার ২৯৩ কোটি টাকার বিনিয়োগ নিবন্ধন কমেছে। এর আগের ছয় মাসে অর্থাৎ জুলাই থেকে wW‡m¤^i ’০৬ পর্যন্ত দেশী উদ্যোক্তারা প্রায় ১২ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিনিয়োগ বোর্ডে।
দেশী উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ যখন এই পরিস্থিতি, তখন বিদেশী বিনিয়োগের চিত্রও আশাব্যঞ্জক নয়। মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি ব্যাপকভাবে কমে যাওয়াই প্রমাণ করে শিল্প খাতে বিনিয়োগ কতটা কমে যাচ্ছে। এরমধ্যে কয়েকদিন যাবৎ শেয়ার বাজারে অব্যাহত দরপতনের কারণে বিনিয়োগকারী মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা আতঙ্কে রয়েছেন। ইতোমধ্যে তারা বিক্ষোভ প্রদশনও করেছেন।
এদিকে দেশে মূল্যস্ফীতির হারও অব্যাহতভাবে বাড়ছে। মূলম্ফীতি দুই অংকের ঘর অনেক আগেই অতিক্রম করে এখন এর হার ১১ শতাংশের বেশি। মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে।
পাঁচ.
¯^ivóª উপদেষ্টা এক ভয়ঙ্কর ও উদ্বেগজনক তথ্য দিয়েছেন। স্থানীয় একটি হোটেলে আয়োজিত “মানব পাচার” রোধে বাংলাদেশ পুলিশের একটি বিশেষ বিভাগের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেছেন, প্রতিদিন অন্ততঃ অর্ধশত নারী ও শিশু ভারতে পাচার হয়। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, এই সংখ্যা কয়েক লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এসব পাচার হওয়া শিশু ও নারী ভারতের কলকাতা, †ev‡¤^mn বিভিন্ন শহরে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে এক লজ্জাজনক তথ্য পাওয়া গেছে।
চারলাখ বাংলাদেশী নারী পাচার হয়ে ভারতে গিয়ে দেহ ব্যবসায় জড়িত হয়ে পড়েছে বা এ ধরণের অভিশপ্ত পেশা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে বলে মহা উদ্বেগজনক ও লজ্জাজনক তথ্য সরকারিভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে নারী-শিশুদের পাচার হওয়া এবং তাদের ভারতের বিভিন্ন যৌনপল্লীতে দেহ ব্যবসায় লিপ্ত হবার তথ্যটি A¯^xKvi করার কোন সুযোগ নেই। এ কারণেই বিষয়টি ভঙ্কর ভাবে উদ্বেগজনক।


ছয়.
বাংলাদেশ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন একই সূত্রে গাঁথা। একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের রেশ না কাটতেই চলে আসে আরেকটি। গত বছর দু’দফা ভয়াবহ বন্যার পরপরই আমরা শিকার হলাম সিডর নামের ঘূর্ণিঝড়ের মরণ কামাড়ের। সে ক্ষত কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আমাদের জাপটে ধরে উচ্চ দ্রব্যমূল্য। ভরা মৌসুমে চালের দাম কিছুটা কমবে এমন আশায় সবাই বুক বাঁধলেও সে আশায় শুধু গুড়ে বালি। ইতোমধ্যে দেখা গেছে বন্যার অশনি সঙ্কেত। নতুন করে আঘাত হানছে নদীভাঙ্গন। গত কয়েকদিনে নদী ভাঙ্গনে দেশের বিভিন্ন স্থানে শতশত ঘরবাড়ি, বিস্তীর্ণ ফসলি জমি , বহু গাছপালাসমেত বিপুল সহায়সম্পত্তি নদীতে বিলীন হয়েছে। এর ফলে গৃহহীন হয়ে হাজার হাজার লোক মানবেতর জীবনযাপন করছে। একই সাথে নদীতীরবর্তী মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে আহাজারি আর আতঙ্ক।
পদ্মা ও তিস্তার ভাঙ্গনে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং এবং কুড়িগ্রামের উলিলপুর উপজেলার কয়েকটি গ্রামের কয়েশ ঘরবাড়ি, অনেক ফসলী জমি ও বৃক্ষসম্পদ নদীতে বিলীন হয়েছে। গৃহহীন হয়ে বহু লোক মানবেতর জীবনযাপন করছে। গত কয়েকদিনে পদ্মার ভয়াবহ ভাঙ্গনে বেশ কিছু বসতবাড়ি এবং প্রায় ২০-২৫ বিঘা ফসলি জমিসহ বহু গাছপালা নদীতে চলে গেছে। বর্তমানে নদীতীরে ৩ শতাধিক পরিবার চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। নিশ্চিহ্ন হয়ে মাওয়া থেকে শ্রীনগর উপজেলার ৪ কিলোমিটার এলাকার পদ্মা তীরবর্তী ফসলি জমি। অন্য দিকে প্রতিদিনই তিস্তা নদীর করাল স্‌্েরাত ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। বসতভিটা। ফসলের ক্ষেত। কলার বাগান ও বাঁশঝাড়।
কিন্তু দুঃখজনক যে, নদীভাঙ্গনের শিকার হয়ে যারা নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন, এখন তাদের পাশে কেউ নেই।
সাত.
গত ২৬ জুন০৮ দেশের নয়টি শিক্ষাবোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের এস এস সি ও সমমানের পরীক্ষার ফল একযোগে প্রকাশিত হয়েছে। সারাদেশে ৭টি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৭০ দশমিক ৮১। গ্রেডিং পদ্ধতিতে ফল প্রকাশের অষ্টম বছরে এবারে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বেড়েছে গড় পাসের হারও। গতবারের চেয়ে এবার পাসের হার বেড়েছে ১৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ। সার্বিক বিবেচনায় এবারের ফল অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
কিন্তু এটা দুঃখজনক খবর হলো, সারা দেশের ৯১ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কেউ উত্তীর্ণ হয়নি। এর মধ্যে ৩৪ টি স্কুল, ৪০ টি মাদ্রাসা এবং ১৭ টি ভোকেশনাল প্রতিষ্ঠান।[সূত্রঃ ইত্তেফাক,২৭.০৬.০৮]
আট.
বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্বমিডিয়া উদ্বিগ্ন। দি ইকোনমিষ্ট, ওয়াশিংটন পোষ্ট, ওয়ালষ্ট্রিট জার্নাল, টাইম ম্যাগাজিনের মতো বিশ্বমিডিয়ায় প্রতিদিন কোনো না কোনো ভাবেই উঠে আসছে বাংলাদেশের খবর। এসব মিডিয়ার বাইরে এফপি, রয়টার্স, এপির মতো বার্তাসংস্থাগুলোও ঐসব প্রশ্নের অবতারণা করছে। সংবাদ মাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে নানা সন্দেহ সংশয় উদ্বেগ-উৎকন্ঠার প্রকাশ ঘটছে।
নয়.
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি শুধু জটিল নয়, অষ্পষ্টও। একদিকে সরকার দেশের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল বি এন পি ও আওয়ামীলীগের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতার ঘোষণা দিয়েছে। সে জন্য সরকার কিছু প্রাথমিক ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে। অপর দিকে জাতীয় নির্বাচনের আগেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের ৪টি সিটি কর্পোরেশন ও ৯টি পৌরসভা নির্বাচনের ঘোষণার মধ্য দিয়ে ষ্পষ্ট হলো, সরকার তার পুরানো অবস্থানেই রয়ে গেছে।
বর্তমান সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা সম্পর্কে কারো মনে কোনো সংশয় নেই। কিন্তু একথা সত্য যে, রাজনীতি মোকাবেলা করার মতো দক্ষ উপদেষ্টা বা ব্যক্তি বর্তমানে সরকারের সঙ্গে যুক্ত নেই। তাই সরকারকে নানা ভুল পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। বর্তমানে সরকারের আরেকটি দুর্বলতা, উপদেষ্টা পরিষদের বাইরেও নানা ক্ষমতা কেন্দ্রের পরামর্শ তাদের শুনতে হয়। যে সব ক্ষমতা কেন্দ্রও যে রাজনীতি মোকাবেলা দক্ষ তা ভাবার কোনো কারণ নেই। রাজনীতি দূরে থাক, সাধারণ মানুষ মোকাবেলা করার মতো অভিজ্ঞতা বা শিক্ষা কোনটাই তাদের নেই।
কাজেই দুই অনভিক্ত শক্তির mgš^‡q সরকার নানা ভুল পদক্ষেপ নিতে নিতে অগ্রসর হচ্ছে। এখন এর সমাপ্তী কেমন হয় সেটাই প্রশ্ন।
দশ.
সামগ্রিকভাবে দেশের এই যখন অবস্থা তখন মনে রাখা দরকার, প্রয়োজন স্থিতিশীলতা। আমাদের বিশ্বাস, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, আদর্শগত এবং অন্য বহুবিধ সমস্যা আমাদের দেশের জনগণের বিশেষ করে রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি সমাজ, বুদ্ধিজীবি শ্রেণী ও সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন স্তরে সকলে মিলে এই সংকট থেকে মুক্তির পথ বের করে নিয়ে আসবে।
লেখকঃ কবি, কথাশিল্পী ও কলাম লেখক

No comments:

Post a Comment