Pages

Saturday, October 9, 2010

আল-জাজিরা এবং বাংলাদেশ



দোহাভিত্তিক আরবি নিউজ চ্যানেল আল-জাজিরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও পশ্চিমা বানোয়াট ঘটনা প্রবাহের সত্য উদ্ঘাটনে অত্যন্ত সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সারা বিশ্বের অগণিত দর্শকের এই পিপাসা উপলব্ধি করেই ২০০৬ সালের ১৫ নভেম্বর আল-জাজিরা ইংলিশ চ্যানেলটি যাত্রা শুরু করে।


বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এই টিভি চ্যানেল যেসব অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে এর স্টুডিওগুলো তৈরি করেছে, আজ পর্যন্ত সেগুলো বিশ্বের ১ নম্বর স্থানেই রয়েছে। এর সবচেয়ে চমৎকারিত্ব হচ্ছে যে, আল-জাজিরার চারটি স্টুডিও বিশ্বের চারটি স্থানে থাকায় বিশ্বের কোথাও এর সূর্য অস্তমিত যায় না এবং চারটি স্টুডিও থেকে একসঙ্গে সারা বিশ্বের খবর প্রচারিত হয়।


স্টুডিওগুলো ওয়াশিংটন ডিসি, লন্ডন, দোহা ও কুয়ালালামপুরে অবস্থিত, যেগুলো ফাইবার অপটিকের মাধ্যমে সংযুক্ত। এর বিশেষত্ব হলো, একটি খবর একই সঙ্গে চার দেশের চারজন প্রেজেন্টারকে দিয়ে সঞ্চালন করা হয়, যা সত্যিই মিডিয়া জগতে এক বিস্ময়কর সংস্করণ।



ছবি : দোহা স্টুডিও

বিশ্বব্যাপী আল-জাজিরার ৩০টি দেশের ৪৫ জাতিসত্তার ৩৫০ জন সাংবাদিকদের নিয়ে একটি অত্যন্ত চৌকস নিউজ টিম অবিরাম বিশ্বের যেকোনো স্থানের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সংগ্রহ করেছে। সারা বিশ্বে আল-জাজিরার চারটি প্রচারকেন্দ্রসহ মোট ২৯টি ব্যুরো অফিস রয়েছে, যা থেকে প্রায় পুরো বিশ্বই আল-জাজিরা সংবাদ নেটওয়ার্কের আওতায় রয়েছে।


আল-জাজিরার সংবাদভিত্তিক অনুষ্ঠানগুলো বিশ্বের সবচেয়ে নামী সাংবাদিকেরা সাজিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: স্যার ডেভিড ফ্রস্টের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাাৎকারভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘ফ্রস্ট ওভার দ্য ওয়ার্ল্ড’, রিজ খানের দর্শকদের অংশগ্রহণভিত্তিক বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিদের প্রশ্নোত্তরবিষয়ক অনুষ্ঠান ‘রিজ খান’। এ ছাড়া রাগে ওমরের ‘উইট্নেস’ এবং ‘রাগে ওমর রিপোর্ট’ আরও রয়েছে পিপল অ্যান্ড পাওয়ার, লিসেনিং পোস্ট, এভরি ওমেন, ওয়ান ও ওয়ান ইস্ট, ফরটি এইট, ইনসাইড স্টোরি ইত্যাদি।

আল-জাজিরার জগৎখ্যাত নিউজ প্রেজেন্টারদের মধ্যে রয়েছেন স্টিফেন কোল, ফেলিসিটি বার, সোহেল রহমান, ভেরোনিকা পেডরোসা, শিউলি ঘোষ, সামি জিদান, ড্যারেন জরডান, নিক কাক, লরেন টেইলর, তেইমুর নাবিলি, আনান্দ নাইডু, মারিয়াম নামাজি, ইমরান গার্দা, কামাল সান্তা মারিয়া প্রমুখ। এ ছাড়া প্রখ্যাত সংবাদদাতাদের মধ্যে রয়েছেন জেমস বেজ, জেন ডাটন, মোহাম্মদ আদো, নূর ওদে, মারগা অরটিগাস, ঘিদা ফাকরি, হোদা আব্দেল হামিদ, জস্ রাশিং প্রমুখ।
আল-জাজিরা ইংলিশ চ্যানেলটি চালু হওয়ার পর থেকে ১৬০ কোটি মুসলিম-অধ্যুষিত এই বিশ্বের মুসলমানদের সুখ, দুঃখ, তাদের জীবনধারা তুলে ধরার একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে এই চ্যানেলটি কাজ করে আসছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুসলমানদের লাঞ্ছনা-গঞ্জনার বিভিন্ন সংবাদ এই চ্যানেল প্রচার করে আসছে, আর ফিলিস্তিনিদের কষ্টের জীবনযাত্রা নিয়ে প্রতিদিন এই চ্যানেলে একটা না একটা অনুষ্ঠান থাকছেই। ইসরায়েলিদের নির্মম নিপীড়নের বীভৎস সব চিত্র একমাত্র আল-জাজিরাই প্রচার করে আসছে। চ্যানেলটি একসময় মর্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খুব একটা জনপ্রিয় ছিল না। তবে গত বছর থেকে এটি টপ চার্টে রয়েছে। ধীরে ধীরে চ্যানেলটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আল-জাজিরা ইংলিশ চ্যানেলের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ, সংবাদের ভেতরকার সংবাদ ও নির্ভীক সত্য সাংবাদিকতার কারণে এখন বিশ্বের এক নম্বর জনপ্রিয় চ্যানেল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।



ছবি : রিজ খান


২০০৬ সালের নভেম্বরে আল-জাজিরা ইংলিশ সম্প্রচার শুরুর পরপরই ওমর তাসিক বাংলাদেশে এটি সম্প্রচারের দায়িত্ব পান এবং ২০০৭ সালেই বাংলাদেশে এই চ্যানেল সম্প্রচারের সরকারি অনুমতি দেওয়া হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে আল-জাজিরায় বাংলাদেশের খবর খুব একটা প্রচারিত হতো না এবং হলেও দু-একজন প্যারাসুট জার্নালিস্ট স্থানীয় কোনো ব্যক্তির সহায়তা নিয়ে ফুটেজ ধারণ করে তা প্রচার করতেন। সে সময় তানভীর চৌধুরী এই সাংবাদিকদের দেশে আসার ব্যাপারে সহযোগিতা করতেন এবং বিভিন্ন সাাৎকারের ব্যবস্থা করতেন। আল-জাজিরায় দেশের প্রথম বড় ধরনের সংবাদ স্থান পায় ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় তখনো বিদেশি সাংবাদিকেরা স্থানীয় সহযোগিতায় সিডরের নিউজ কভার করেন। এরপর প্রথম বাংলাদেশের ব্যাপক ও বড় আকারের সংবাদ প্রচারিত হয় ২০০৮ সালের নির্বাচনকে ঘিরে। এ সময় আল-জাজিরার এক বিশাল নিউজ টিম বাংলাদেশে আসে। বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক জেমস বেজ, সোহেল রহমান, এশিয়া অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান প্রযোজক আলেকজ্যান্ড্রা গিসহ আরও ছয়জন সংবাদ ক্রু ও প্রকৌশলীর সঙ্গে স্থানীয় প্রযোজক হিসেবে ওমর তাসিক ও তানভির চৌধুরী কাজ করেন। পুরো নির্বাচন প্রস্তুতি, নির্বাচনের দিন ও নির্বাচন-পরবর্তী বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিপ্রেতি নিয়ে টানা ১২ দিন নিয়মিত এই সংবাদ প্রচার হয়। এ জন্য হোটেল শেরাটনে একটি অস্থায়ী স্টুডিও স্থাপন করা হয়। এর পর থেকেই বাংলাদেশের যেকোনো ঘটনাই আল-জাজিরার সংবাদে বেশ ভালোভাবেই স্থান পেতে থাকে এবং ২০০৮ সালে বাংলাদেশে একজন স্থায়ী করেসপনডেন্ট নিয়োজিত হন তিনি হলেন নিকোলাস হক। নিকোলাস হকের সঙ্গে ওমর তাসিক সংবাদ প্রযোজক হিসেবে এবং সুলায়মান হোসেন শাওন ক্যামেরাম্যান হিসেবে নিয়মিত সংবাদ প্যাকেজ নির্মাণের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এর ফলে আল-জাজিরার সংবাদে বাংলাদেশ এক নতুন জায়গা করে নিয়েছে এবং প্রায় প্রতি সপ্তাহেই দু-একটি বাংলাদেশি খবর প্রচারিত হচ্ছে। ওমর তাসিক বাংলাদেশে আল-জাজিরা সম্প্রচারের দায়িত্বের পাশাপাশি সংবাদ প্রযোজক হিসেবে নিকোলাস হকের সঙ্গে কাজ করে চ্যানেলটিতে যেসব গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রেরণ করেছেন, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: বিডিআর বিদ্রোহ, বসুন্ধরা সিটিতে অগ্নিকাণ্ড, বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের ফাঁসির আদেশ কার্যকর, বাংলাদেশের সংবাদ প্রচারের স্বাধীনতার ওপর প্রামাণ্যচিত্র, জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের অবস্থান, বিশ্বমন্দায় বাংলাদেশের শিল্প-কারখানাগুলোর সার্বিক অবস্থা, বিশ্ব উষ্ণায়ন ও বাংলাদেশ ইত্যাদি।


আল-জাজিরার বিভিন্ন প্রোগ্রাম যেমন ওয়ান ও ওয়ান ইস্ট, পিপল অ্যান্ড পাওয়ার এগুলো সরাসরি নিয়ন্ত্রিত হয় সংশিষ্ট অনুষ্ঠান প্রযোজকদের দিয়ে। এগুলো নিয়মিত করেসপনডেন্ট বা নিউজ প্রডিউসারদের সঙ্গে সংশিষ্ট নয়, এ কারণে অনেক সময় স্থানীয় করেসপনডেন্ট জানতে পারে যে বাংলাদেশে কোনো বিশেষ প্রোগ্রামের চিত্র ধারণ করা হবে। তবে সংশিষ্ট সাংবাদিক যদি লোকাল টিমের সহায়তা না নেন তখন তার দায়ভার স্থানীয় সাংবাদিকদের ওপর বর্তায় না। তবে বেশির ভাগ সময়ই তারা স্থানীয় টিমের ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশে বর্তমানে যারা আল-জাজিরা নেটওয়ার্কের সঙ্গে সরাসরি এবং নিয়মিত চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োজিত আছেন তারা হলেন: ওমর তাসিক (বাংলাদেশ সম্প্রচার প্রধান বাংলাস্যাট ও সংবাদ প্রযোজক), নিকোলাস হক (করেসপনডেন্ট), মো. সুলাইমান হোসেন শাওন (ক্যামেরাম্যান), সেলিম আল মাহবুব (ন্যাশনাল ডিস্ট্রিবিউশন কো-অর্ডিনেটর বাংলাস্যাট), আঞ্জুমানারা বেগম (ডিষ্ট্রিবিউশন ম্যানেজার বাংলাস্যাট) এবং রাশেদুল ইসলাম (অফিস এক্সিকিউটিভ বাংলাস্যাট)। আল-জাজিরার এই টিম তাদের সব কার্যক্রম এসইএল সেন্টার (৮ম তলা) ২৯ পশ্চিম পান্থপথ, ঢাকা-১২০৫ থেকে পরিচালনা করছে।


তথ্যসূত্র : আল জাজিরা ডটনেট ও মিডিয়াওয়াচ