Pages

Tuesday, July 13, 2010

ডাক্তার বাড়িতে নানা রঙের দিন


৬ মে ২০১০। বৃহস্পতিবার। সময়টা একটু গরম, এক পশলা মেঘ, একটু বৃষ্টি । চারদিক কেয়া, কদম ফুলের সুবাসিত সৌরভ। রাত তখন বাজে পৌণে দশটা। ফেনীর সোনাগাজী যাবো।

ফেনী বাস স্ট্যাণ্ড থেকে ডানে টার্ণ নিয়ে সোজা সামনে দিকে যাচ্ছি। চারপাশ অন্ধকার। বর্তমান ঢাকার লোডশেডিং এর হাওয়া ফেনীতে ভালমতোই বুঝা যাচ্ছে।

সামনে যাচ্ছি। কিন্তু গাড়ী চালক রনি এর পূর্বে একবার এসেছিল সোনাগাজীতে। ফলে ঠিকমত অন্ধকারে গন্তব্য চিনতে পারতেছিলনা। আর আমি জীবনে এই প্রথম এসেছি।

কী আর করা। যাচ্ছি তো যাচ্ছি। সামনেই এক বাজার। নাম ধলিয়া। ঔ বাজার ক্রস করতেই রাস্তার বামে ক্রস করতে রিক্সার সাথে আমাদের গাড়ীটা লেগে গেল। চারপাশ অন্ধকার। আমি শুধু চেয়ে দেখলাম রিক্সাচালক ভাইটি মাটিতে পড়ে গেল আর রিক্সাটা উল্টা দিকে ধপাস।

ওহ!! বুকের মধ্যে তখন আমার ৯০ ডিগ্রি হার্টবিট উঠানামা করছে। পরে খোঁজ খবর নিয়ে যানতে পারি রিক্সাওয়ালা কোন গুরুতর আঘাত পাননি। তবুও আমাদের মনে প্রচণ্ড খারাপ লাগল। রনিকে অনেক বলা সত্ত্বেও গাড়ীটা ব্যাক করলনা। আমরা গাড়ীতে বসা সবাই বলতেছি অন্তত রিক্সাওয়ালা ভাইটিকে দুঃখিত বলা দরকার। কিন্তু রনি খুবই শক্ত। ও গাড়ী শাঁ শাঁ করে চালিয়ে নিয়ে গেল নির্দিষ্ট গন্তব্যের প্রায় আধ ঘন্টার পথ দূরে। এমনিতেই বিদ্যুৎ নেই। চারদিকে অন্ধকার। আমরাও খুঁজে পাচ্ছিনা ডাক্তার বাড়িটা।

কী আর করা। বাধ্য হয়ে আবার আমরা উল্টা দিকে আসতে থাকলাম। নানা অস্থিরতার পর খুঁজে পেলাম বাড়িটি।

সুনসান নীরবতা। গাছগাছালিতে পাখিদের কিচির মিচির। মাঝে মাঝে দু-একটা ঝিঝি পোকার শব্দ। ব্যাগ থেকে ফায়ার বক্স (দিয়াশলাই) বের করে গাড়ী থেকে নামলাম। ডাক্তার বাড়ীতে আমরা যে ঘরে থাকব সে ঘরের চাবিটা ছিল ঐ বাড়িতে অবস্থানরত ডা. ইকরামুল হক এর কাছে। তাঁর সেলফোনে কল করতেই উনি ঘর থেকে বের হলেন। সাথে আরো কয়েকজন ( লিমার হাতে চার্জার লাইট )।

আমরা ঘরের ভেতর প্রবেশ করলাম। সাথে সাথে বিদ্যুৎ চলে আসল। দীর্ঘ একমাস পর তালাবদ্ধ ঘর যেন মূহুর্তের মধ্যেই বাতিঘরে পরিণত হল। নতুন করে প্রাণ ফিরে পেল।

নানা রঙের দিন...

৪ জানুয়ারি, ১৯৬৪ সাল। সেই সময় নাম ছিল চৌধুরী বাড়ী। বর্তমানে ডাক্তার বাড়ী। মাঝে অতীত হয়ে গেছে সর্দার বাড়ী নামটা। বর্তমান মহাজোট সরকার নাম বদলের যে ইতিহাস রচনা করেছেন, এই বাড়ীটি সেই ইতিহাসকে ছাড়িয়ে (সম্ভবত) গ্রিনেজ বুক অব ওর্য়াল্ড-এ উঠে যাবে।

প্রিয় পাঠক, হয়তো আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ডাক্তার বাড়ীতে আমার প্রথম আসা কিন্তু নানা রঙের দিন- শিরোনাম কেমনে হয়? প্রসঙ্গত বলব, এই বাড়ীতে পরিচয় হয় এক ভাবীর সাথে। বর্তমান বয়স তাঁর প্রায় সত্তর বৎসর। নানান কথা জানতে জানতে উনি বলল, সেই সময়কার নানা রঙের দিনের স্মৃতি।

ডাক্তার বাড়ীর সবাই এই ভাবীকে মুক্তা ভাবী বলে ডাকত। ভাবীর বাপের বাড়ী কুমিল্লায়। ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি গোলাম মোস্তফার সাথে পরিণয়নসুত্রে ডাক্তার বাড়ীতে আসেন।

দেবর-ননদ-ভাসুর-ভাগ্নে-ভাগ্নী-পাড়া প্রতিবেশী সবাই মিলে ২২০ জন ভাবীর বিয়েতে যায়। প্রথম শ্বশুর বাড়ীতে যখন আসেন তখন ভাবী অন্য এক স্বাপ্নিক রাজ্যে অবস্থান করছেন।

চারদিক থেকে সবাই আসছেন তাকে দেখতে। সেই সময় নতুন বউকে সবসময় ঘোমটা পরে থাকতে হতো। শুধুমাত্র স্বামীর সামনে ঘোমটা খুলতে পারতো। অন্য পুরুষের সামনে যেতে পারতনা। উচ্চস্বরে কথা বলতে পারত না। শ্বশুর-শ্বাশুড়ির কথা মতো সব কিছু মেনে চলে জগৎ সংসার চালাত। অন্যরকম একটা পরিবেশ ভাবীকে প্রতিদিন পৃথিবীর সোনালী জীবনের এক নাট্যমঞ্চে অভিনয় করতে হতো।

এভাবেই দিন-মাস-বছর পেরোতে থাকে। বছর এক পরেই পৃথিবীতে আসে নতুন এক সন্তান। তখন ভাবী পুরোপরি এক গৃহিনীতে রূপান্তরিত একজন মহিলা। প্রতিদিন স্বামীর অফিসে যাওয়ার সময় সব কিছু প্রয়োজনীয় কাজ গুছানো, বাচ্চাকে লালন করা, শ্বাশুড়ির আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা-ইত্যাদি নানা কাজের সব বিচিত্র সাংসারিক আয়োজনে ব্যাস্ত। এভাবেই দিন কেটে যায় ভাবীর।

কথা প্রসঙ্গে সেই সময় আর বর্তমান সময় এর সাংসারিক কী কী পরিবর্তন হয়েছে জানতে চাইলে ভাবী জানালেন, বর্তমান সময়টা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর আগের মতো সংসার জীবন নেই। এখন নতুন বউরা ঘরে এসেই স্বামী ছাড়া অন্য কাউকে ( শ্বশুড়-শ্বাশুড়ী-দেবর-ননদ) সহজে চিনতেই চায়না। বিয়ের পরপরই আলাদা সংসার করতে চায়। যা আমাদের সময় ছিলনা। আর পর্দাতো করতেই চায়না। এমনকি মাথায় কাপড় পর্যন্ত দিতে চায়না।

খুব প্রতিবাদের সুরে বললেন, এই দেখ, কয়েকদিন আগে ঢাকা থেকে সোনাগাজীতে আসতেছিলাম। তো তখন আসরের সময়। মাইকে আজান হচ্ছে। দেখলাম ওই বাসে বারো জন মহিলা ছিল। অথচ আজান শুনার সাথে সাথে মাত্র চার জন মহিলা মাথায় কাপড় দিল। ব্যাপারটা আমার কাছে লক্ষ্যনীয়। আসলে এভাবেই পরিবর্তন হয়েছে এখনকার সমাজ।

জোনাকী পোকার সাথে কিছুক্ষণ

এভাবে ভাবীর সাথে আলাপচারিতায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। সন্ধ্যার আধঘন্টা পরে বিদ্যুৎ চলে গেল। আমি, রনি চলে গেলাম ডা. বাড়ির সামনে রাস্তায়। রাস্তার পূর্বদিকে একটা ছোট সাকোঁ। সাকোঁটার পাশে ছোট্ট ডোবাশয়। তখন অন্ধকার রাত। অথচ এই ডোবাশয়ে দেখলাম হাজারো জোনাকী পোকার মিটিমিটি আলো। সাথে ঝি ঝি পোকার কলকাকলী। রনি আমাকে বলল, সাইফ ভাই, দেখেন আল্লাহর কী অপরূপ সৃষ্টি। প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ হাজার জোনাকী একসাথে আলো ছড়াচ্ছে। আমি জীবনেও দেখিনি। আমরা কিছুক্ষণ জোনাকীর সাথে কাটালাম।